সংবাদ পরিক্রমা
- অভিজিৎ হত্যাঃ ১ম ও ১০ম দিবসে প্রতিক্রিয়ামাসুদ রানা
[ঢাকাতে বাঙালী মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের দিন আমি একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লিখেছিলাম। তারপর দশ দিন কেটে গেলো। ঘটনাটি মন থেকে সরছে না। আজও লিখলাম অভিজিৎ হত্যা নিয়ে। - মাসুদ রানা]
১ম দিবস।। ব্লগার অভিজিৎ রায় খুনঃ ভয়ঙ্কর মৃত্যুর তৃতীয় ধারা
আমেরিকা থেকে মাতৃভূমি বাংলাদেশে বেড়াতে-যাওয়া ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তাঁর এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদটা পড়ে আমি যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
জানা গেলো, তিনি বইমেলা থেকে ফিরছিলেন। শুনেছি, অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের মতো ঠিক একই স্থানে অভিজিৎ রায়কে আক্রমণ করে, একই কায়দায় ধারালো অস্ত্রে আঘাত করা হয়। হুমায়ূন আজাদ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঐ সময়ে বেঁচে গিয়েছেন, কিন্তু অভিজিৎ রায়কে মৃত্যু পরাজিত করে দিয়েছে। হন্তারকেরা কাপুরুষ। তাঁর স্ত্রীকেও আঘাত করেছে ওরা। তাঁর হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে। তিনি এখন মৃত্যুর সাথে লড়ছেন।
অভিজিৎ রায় 'মুক্তমনা' নামের একটি ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যতঃ পরিচালক ছিলেন। তিনি নিজে সেখানে প্রধানতম লেখক ছিলেন। বিজ্ঞানের পক্ষে এবং ধর্মের বিরুদ্ধে - বিশেষতঃ ইসলামের বিরুদ্ধে - লিখতেন বলে নাস্তিকদের মধ্যে জনপ্রিয় ও ইসলামবাদীদের কাছে ঘৃণিত ছিলেন অভিজিৎ রায়।
অভিজিৎ রায়ের আক্রান্ত হওয়ার স্থান, সময় ও প্রকার যে প্রতীক নির্মাণ করে, তাতে সন্দেহের কারণ আছে, তাঁকে ধর্মবাদীরা মেরে থাকতে পারে। মানুষের চিন্তা ও চিন্তার প্রকাশ যাই হোক না কেনো, তার জন্যে তাঁর শরীর ও প্রাণের ওপর আঘাত মেনে নেওয়া যায় না। কোনো মতেই মেনে নেওয়া যায় না।
অভিজিৎ রায়ের প্রাণসংহার আমাকে ভীষণভাবে আঘাত করেছে। আমি তাঁকে চিনতাম, যদিও বাস্তবে সাক্ষাত হয়নি। ২০১০ সালে তাঁর মুক্তমনায় আমি একটি কমেণ্ট লিখেছিলাম বিজ্ঞানে মতবাদ আছে কি নেই তা নিয়ে প্রকাশিত একজন লেখকের লেখার সূত্র ধরে। সেদিনই অভিজিৎ রায় নিজেই আমার নামে একটি এ্যাকাউণ্ট খুলে পাসওয়ার্ড পাঠিয়ে লিখতে অনুরোধ করেছিলেন।
আমি অবাক হয়েছিলাম। অভিজিৎ রায়ের অনুরোধ ফেলতে পারিনি। তাই লিখতেও শুরু করেছিলাম, যদিও মার্ক্সবাদ নিয়ে জনৈক ডঃ বিপ্লব পালের সাথে বিখ্যাত তর্কের পর না-লেখার সিদ্ধান্ত নিই। ভেবেছিলাম, একবার সময় করে ওঁর সাথে কিছু মত-বিনিময় করবো অন্ধ বিশ্বাসের বিপরীতে র্যাশনালিজম প্রচারের মানবিক ষ্ট্র্যাটেজি নিয়ে।
আমি মানুষের বিশ্বাসকে অপমান করে জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচারের নীতিতে বিশ্বাসী নই, কিন্তু আজ অভিজিৎ রায়ের এই প্রাণ কেড়ে নেওয়া নৃশংসতার প্রেক্ষিতে আমি তাঁর প্রাণের পক্ষে অবস্থান নেবোই। আজ আমি সেই অবস্থান থেকে তাঁর হত্যাকাণ্ডের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।
অভিজিৎ রায়ের এই হত্যাকাণ্ডে আমি রূপতঃ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। আমি বিমর্ষ, উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। কারণ, এটি শুধু মৃত্যু নয়। একটি মৃত্যুর চেয়ে অধিক - মৃত্যুর ধারা। পেট্রৌলবোমায় ও তথাকথিত ক্রসফায়ারের পর এটি হচ্ছে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর তৃতীয় ধারা।
বাংলাদেশ আজ ডেথ থিয়েটার বা মৃত্যু-আলয়ে পরিণত হয়েছে। মৃত্যু হানা দিচ্ছে নানাভাবে। হানা আসছে নানা দিক থেকে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ গভীর অন্ধকারের দিকে এগুচ্ছে।
বৃহস্পতিবার, ১৪ ফাল্গুন ১৪২১ বাং, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৫ ইং, লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড
১০ম দিবস।। অভিজিৎহীন দশদিনঃ ঘাতক তুমি মানুষ ছিলে?আজ 'মুক্তমনা'য় গিয়েছিলাম আমার পুরনো একটা লেখা দেখতে। ওখানে পেয়ে গেলাম অভিজিৎকেও। ওর করে দেওয়া আমার এ্যাকাউণ্টটা এখনও সচল। তখনকার লেখা ওর স্বাগতিক সম্ভাষণ পড়ে মনে হলো দীর্ঘকাল আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো বন্ধুর সাথে দেখা।
হায়, পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেলামঃ অভিজিৎ নেই! বিশ্বচরাচরে দশটি রাত ভোর হয়েছে, অভিজিৎ নেই। ফেব্রুয়ারীর বইয়ের মেলা শেষ হয়েছে, অভিজিৎ নেই। সুন্দর এই পৃথিবী স্বাভাবিক চলছে, অভিজিৎ নেই। কারণ, ঘাতক তুমি অভিজিতের প্রাণ কেড়ে নিয়েছো।
কতোদিন পর অভিজিৎ ফিরে এসেছিলো মাতৃভূমিতে। কেনো আসে মানুষ ফিরে ফিরে মাতৃভূমিতে? মাটি ও মানুষকে ভালোবেসেইতো ফিরে ফিরে আসে। জাতিময় ও জাতিবিভক্ত এই গ্রহের মানুষ আমরা কোথায় জন্মি, কোথায় বেড়ে উঠি, কোথায় যাই! কিন্তু যেখানেই যাই না কেনো, মাতৃভূমিকে কি ভুলতে পারি?
বাংলার বুকে বার বার ফিরে এসে অভিজিৎ শৈশবের মতো, কৈশোরের মতো, যৌবনের মতো নির্ভয়ে, নিঃসঙ্কোচে, স্বাধীনভাবে হাঁটতে চেয়েছিলো। চির পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণমালাময় চত্তরে, বাংলা এ্যাকাডেমীতে, শাহবাগে, টিএসসিতে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটতে চেয়েছিলো অভিজিৎ।
ঘাতক তুমি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তাঁকে লাশ করে মাটিতে ফেলে দিলে! সে তোমাকে এতোটুকু বাধাও দিতে পারেনি। কী নিরীহ ছিলো মসিধারী অভিজিৎ। আর কী নিষ্ঠুর ছিলে তুমি অসিধারী ঘাতক!
তুমি তার চারপাশে ঘুরঘুর করছিলে মৃত্যুদূত হয়ে। অভিজিৎ এতোটুকু সন্দেহ করেনি তোমাকে। সে ভেবেছিলো তুমি তার মায়ের ছেলে বাঙালী। ভেবেছিলো তুমি তার ভক্ত সুহৃদ। ভেবেছিলো তুমি তার মুগ্ধ পাঠক। তুমি কি তার অটোগ্রাফও নিয়েছিলে? কী নিষ্ঠুর ছলনায় তুমি তাকে ভুলিয়েছিলে, ঘাতক!
কী সহজে তুমি প্রাণ নিয়ে গেলে, ঘাতক! তুমি কি প্রাণ দিতে পারো? কখনও কি পারবে অভিজিৎকে ফিরিয়ে দিতে? অথচ, তুমি এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে আছো। তুমি কে এবং কোথায় আছো জানি না। কিন্তু এটি জানি, অভিজিৎ আর এই পৃথিবীতে নেই।
ঘাতক তুমি সত্যিই তোমার প্রভূর নামে খুন করেছো তোমার প্রভূর পথ সমালোচনা করার জন্য? তোমার প্রভূ তোমায় তাই বলেছেন? তোমার প্রভূ সৃষ্টি করেন? তোমার প্রভূ মৃত্যু লিখেন? তোমার প্রভূ বিচার করেন পরকালে? জন্ম-মৃত্যু-বিচার যদি তোমার প্রভূর হাতেই হবে, কেনো তুমি তোমার হাতে নিলে? তোমার প্রভূ এতো অক্ষম? এতো নির্মম?
ঘাতক শোনো! মৃত্যু কেমন বুঝবে তুমি, যেদিন তোমার মৃত্যু হবে। বুঝবে তুমি পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কতো সুখের, কতো মধুর। বুঝবে তোমার স্বজনেরা তুমি-হারা জীবন তাদের দুঃখে ভরা কতো বিধুর। ঘাতক তুমি বুঝবে কেবল মানুষ হলে।
সত্যি বলো ঘাতক তুমি, মানুষ হয়ে জন্মেছিলে? মানব হয়ে জন্ম নিলে, এখন কেনো দানব হলে? ঘাতক তুমি সত্যি বলো, সত্যি তুমি মানুষ ছিলে?
রোববার, ২৪ ফাল্গুন ১৪২১ বাং, ৮ মার্চ ২০১৫, লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড