সংবাদ পরিক্রমা
- বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে স্বৈরাচারঃ ‘বাকশাল’ থেকে ‘বাছশাল’মাসুদ রানা
বাকশাল
বাংলার পূর্বখণ্ড যখন পাকিস্তানের উদর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে ভূমিষ্ঠ হয় ১৯৭১ সালে, তখন আশা করা হয়েছিলো দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে ‘গণতন্ত্র’। এই তন্ত্রটিকে মন্ত্র করে এক বছর পর ১৯৭২ সালে রচিত হয়েছিলো সংবিধান, যাকে বঙ্গজ সমাজন্ত্রীরাও পর্যন্ত মনে করেন এক ‘বিশাল অর্জন’।
সেই ‘অর্জন’কে বর্জন করলেন দেশটির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তিন বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালে। সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলেন তিনি। নিজ-দল আওয়ামী লীগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি-সহ কিছু অনুগত ‘বি-টীম’। আর নাম দিলেন ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ - সংক্ষেপে ‘বাকশাল’। বাকশাল ছিলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ইতিহাসে আবির্ভূত প্রথম স্বৈরশাসন।
কিন্তু হায়, বাকশাল প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে খুন হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। নানা কলা-কৌশল করে অল্প সময়ের মধ্যেই পরবর্তী একনায়ক রূপে আবির্ভূত হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। উল্লেখ্য, তিনিও ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটীর অন্যতম সদস্য।
জিয়াউর রহমানও খুন হলেন ১৯৮০ সালে। ১৯৮২ সালে আরও নাটকীয় ভাবে আবির্ভূত হলেন তৃতীয় একনায়ক, জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি বাকশালের সদস্য ছিলেন কি-না, সে তথ্য অনুসন্ধেয়। তবে, তাঁর ক্ষমতারোহণে ও প্রহসনের নির্বাচনে বাকশাল-স্রষ্টার কন্যা শেখ হাসিনার সমর্থন ছিলো বিলক্ষণ। এখনও ইনি ও তিনি একজোট ‘মহাজোট’ নামে।
বাছশাল
ইতিহাস বার-বার ফিরে আসে। তবে ভিন্ন-ভিন্ন রূপে। কারণ, ইতিহাসের উত্থিত ঘটনা অপসৃত হলেও প্রায়শঃ সংস্কৃতিতে প্রবণতা হয়ে বিরাজ করে। আর উপযুক্ত পরিস্থিতি এলেই তা বিস্মরণ ভেঙ্গে আবির্ভূত হয় সশরীরে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাকশাল-প্রবণতা সম্প্রতি দেশটির শিক্ষাঙ্গনে পুনর্জ্জীবিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর রূপে। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী ছাত্রলীগের সাথে 'আওয়ামী' শিক্ষকগণ মিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একেকটা আওয়ামী রাজত্ব গড়ে তুলেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফী ১,৮২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬,২৭৫ টাকা করা হয়েছে। এটি রীতিমতো অন্যায়। আর, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রতিবাদকারী ছাত্র-ছাত্রীগণ। কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপদের দিক হচ্ছে, সেই আক্রমণে অংশগ্রহণ করেছেন আওয়ামী শিক্ষকগণও।
আওয়ামী ছাত্র-শিক্ষকদের এই যে ‘আনহোলী এ্যালায়েন্স’, প্রকৃত প্রস্তাবে এর ন্যায্য নাম হতে পারেঃ বাংলাদেশ ছাত্র-শিক্ষক আওয়ামী লীগ - সংক্ষেপে ‘বাছশাল’। ‘বাছশাল’-এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আওয়ামী আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক কর্মসূচির সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ জিগির তোলা এবং এর বিরুদ্ধাচারণকারীকে শক্তি প্রয়োগে দমন করা।
‘বাছশাল’-এর যে-বিকট প্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, দেশটির টেলিভিশনগুলোতে তার ফুটেইজে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর তাঁর আওয়ামী ছাত্রদের সাথে মিলে ঘুষি মারছেন ছাত্রফ্রন্টের একটি মেয়েকে। অত্যন্ত অসভ্যের মতো আওয়ামী ছাত্র-শিক্ষকরা নির্যাতন করছেন ছাত্রফ্রন্টের ছেলে-মেয়েদের।
শারীরিক আক্রমণ ও নির্যাতনেই শেষ নয়। ‘বাছশাল’ তার পেশী শক্তির পাশাপাশি প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করে বহিষ্কার করেছে আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের। ছেলে-মেয়ে, হিন্দু-মুসলিম, বাঙালী-ত্রিপুরী মিলে মোট ৯ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছেন বাকৃবি’র বাছশাল।
অন্যায়, নির্যাতন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার এই বাছশাল-কর্মের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে দেশটির সংবাদ-মাধ্যমগুলোতে। সংবাদ প্রকাশিত হবার পর সরকারের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় একটি তদন্ত কমিটী গঠন করেছিলো। নিয়ম-মাফিক, সেই তদন্ত কমিটী আক্রমণকারী প্রক্টরকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করেছে।
বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটে এবং অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে যখন ভিডিও ফুটেইজে বার-বার দেখানো হচ্ছে যে ‘নির্দোষ’ প্রক্টর সাহবে সত্যি-সত্যিই ঘুষি মারছেন ছাত্রফ্রন্টের মেয়েটিকে, তখন বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন তদন্ত কমিটীর প্রধান। হাইকৌর্টের নির্দেশে ছাত্রফ্রন্টের ৯ জনের ‘বহিষ্কারাদেশ’ স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিষয়টি বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরী করেছে। সকলেই বিস্মিতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কীভাবে একজন ছাত্রীকে ঘুষি মারতে পারেন? সাধারণ বিবেচনায় এর কোনো জবাব নেই। এর জবাব খুঁজতে হবে অসহিষ্ণু ‘বাছশাল’ আদর্শবাদের মধ্যে। অসহিষ্ণু আদর্শবাদ, তার নাম যা-ই হোক না কেনো, মানুষকে নির্যাতক বানাতে বাধ্য।
ছাত্রফ্রন্ট আক্রান্ত কেনো?
ছাত্রফ্রন্টের অপরাধ হচ্ছে এর জন্মকালীন প্রতিশ্রুতিঃ সর্বজনীন, অবৈতনিক, সেক্যুলার ও বিজ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষার দাবি। এটি হচ্ছে শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে একটি সমন্বিত বোধ। সেই বোধের কারণে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট বাংলাদেশের অগ্রবর্তী চিন্তার পথিকৃৎ হিসেবে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির অঙ্গনে ক্রিয়াশীল রয়েছে।
১৯৮৩ সালে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নাম পরিবর্তন করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের জন্ম হয় সেই সময়কার চলমান শিক্ষা-আন্দোলনের মধ্যে। আশির দশকের ছাত্র-আন্দোলনে ছাত্রফ্রন্টই দেখিয়েছিলো, বস্তুতঃ আইয়ুব-আমলের শরিফ শিক্ষা কমিশন, মুজিব আমলের কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন, জিয়া-আমলের কাজী জাফর শিক্ষা রিপৌর্ট এবং এরশাদ-আমলের মজিদ খান কমিশন এক ও অভিন্ন। কারণ, এদের সবগুলোই উচ্চ-শিক্ষার সর্বজনীনতাকে অস্বীকার করেছে এবং উচ্চশিক্ষাকে ‘হাইলী সিলেক্টিভ এ্যাণ্ড কস্ট বেইসিস’ হিসেবে দেখেছে। বলেছে, উচ্চ-শিক্ষা সবার জন্য নয় এবং উচ্চ-শিক্ষা বিনামূল্যে পাবার বস্তুও নয়।
কিন্তু ছাত্রফ্রন্ট সাম্যবাদী দর্শনে গড়ে ওঠার কারণে মনে করে, পৃথিবীতে আজকের জ্ঞানভাণ্ডারে যা কিছু আছে, তা সমগ্র মানবজাতির সম্মিলিত সংগ্রামের ফল। একটি বিশেষ দেশ, বিশেষ জাতি কিংবা বিশেষ শ্রেণীর একার ভোগ্যপণ্য নয় এটি। তাই, নতুন প্রজন্মের সকল মানুষের জন্য পূর্ববর্তী প্রজন্মের সকল জ্ঞানকে উন্মুক্ত করে রাখতে হবে।
‘সমাজতান্ত্রিক’ হবার কারণে ছাত্রফ্রন্ট মনে করে, নাগরিককে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষিত করার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। কোনো প্রকারের ব্যক্তি মালিকানাধীন ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বাস করে না ছাত্রফ্রন্ট। ছাত্রফ্রন্ট মনে করে, শিক্ষা হবে শিক্ষার্থীর জন্য সম্পূর্ণরূপে নিখর্চায়। রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে এর সমস্ত ব্যয়।
ছাত্রফ্রন্ট দেখিয়েছে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ১৯৬২ শিক্ষার আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ছাত্র-সমাজের যে অগ্রণী ভূমিকা ছিলো, তার পেছেনে কাজ করছে সর্বজনীন, অবৈতনিক, সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক শিক্ষার ব্যবস্থা ও অধিকারের আকাঙ্খা।
আজ যখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফী’র নামে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে হাজার-হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এর বিরোধিতা করেছে। স্বভাবতঃ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিষয়টি ইতিবাচক আবেদন তৈরী করেছে। আর তাতে ক্ষেপে গিয়েছে বাছশাল - বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষক আওয়ামী লীগ।
জঘন্য বর্বরতায় আক্রমণ করেছে আওয়ামী ছাত্ররা। কিন্তু ছাত্রফ্রন্টের ছেলেরা নির্ভীক। নির্ভীক মেয়েরাও। এর আগেও আমরা লক্ষ্য করেছি, কীভাবে বরিশাল মেডিক্যাল কলেইজে আওয়ামী ছাত্ররা আক্রমণ করেছে ছাত্রফ্রন্টের মেয়েদের উপর। কিন্তু সেখানেও মেয়েরা রুখে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখনই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ছাত্রফ্রন্ট অগ্রবর্তী হয়ে সেখানে আন্দোলনের বুহ্য রচনা করেছে। আর যেখানেই ছাত্রফ্রন্ট আন্দোলনে অগ্রবর্তী হয়েছে, সেখানেই এর ছেলে-মেয়েরা আক্রান্ত হয়েছে। ওরা রক্তাক্ত হচ্ছে কিন্তু সংগ্রামের পতাকা ফেলে দিচ্ছে না। এই চিত্র আমরা দেখছি, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, দিনাজপুরে, বগুড়ায় ও গাইবান্ধা-সহ বিভিন্ন স্থানে।
শিক্ষার অধিকারের প্রতি ছাত্রফ্রন্টের ছেলে-মেয়েদের এই প্রতিশ্রুতি, দৃঢ়তা ও সাহসিকাতা নজরহীন হয়নি মানুষের কাছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যে মাটিতে, সেই ময়মনসিংহের মানুষ দাঁড়িয়েছেন ছাত্রফ্রন্টের ছেলে-মেয়েদের পক্ষে। তাঁরা রাস্তায় মানব-বন্ধন করছেন ছাত্রফ্রন্টের ছেলে-মেয়েদের পক্ষে। তাঁরা ধিক্কার জানাচ্ছেন গুণ্ডা-সদৃশ্য সেই ‘শিক্ষক’ প্রক্টরকে। তাঁরা পদত্যাগ দাবি করছেন ছাত্রী-নির্যাতনকারী প্রক্টরের।
স্পষ্টতঃ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বাছশালের বিরুদ্ধে এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন মানুষের শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নে।
রোববার, ২১ অক্টোবর ২০১২
নিউবারী পার্ক
এসেক্স, ইংল্যাণ্ড
masudrana1@gmail.com