সংবাদ পরিক্রমা
- যুদ্ধাপরাধের স্থানিকীকরণঃ পাকিস্তানীদের বিচার চাইবে কে?
আজ মঙ্গলবার। ষোলই ডিসেম্বর। ১৯৭১ থেকে ২০০৮ - বাংলাদেশ পালন করছে তার স্বাধীনতার যুদ্ধ-বিজয়ের সাঁইত্রিশতম বার্ষিকী। ব্রিটেইনের বাঙালীরাও এই গৌরবান্বিত দিবসটি পালন করছে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ঘাতক-দালালদের বিচার দাবী-করে।
ঊনিশশো বিরানব্বই সালের শুরুর দিকে শহীদ-জননী জাহানারা ইমামের উদ্যোগে গঠিত গণ-আদালতের পরে সাম্প্রতিক মাসগুলোতেই সম্ভবতঃ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি সবচেয়ে জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মতো পুরোনো কিংবা সেক্টর কমান্ডার্স ফৌরামের মতো নব-গঠিত জাতীয় পর্যায়ের সংগঠনগুলো-সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বলা অসংখ্য রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধারের বিচারের দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে। বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত প্রার্থীদের পরাজিত করার প্রচারণাতেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে সবল ভাব।
বর্তমানে লক্ষ্য করার বিষয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবী বলতে পাক-হানাদার বাহিনীর বঙ্গীয় সহযোগী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তিবাহিনীর বিচার করার কথাই মূলতঃ বলা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের এহেন স্থানিকীকরণ একাত্তরের মূল অপরাধীদের উহ্য করে দেয়ার সমূহ বিপদ তৈরী করছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একাত্তরকে আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তাকেও ঠেলে দিচ্ছে প্রায় অসম্ভবের পথে।
রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তিবাহিনীর লোকেরা একাত্তরে স্বজাতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, সম্পদ-ধ্বংস, তথ্য সংগ্রহ-সরবরাহ আর মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী প্রচার-প্রচারণায় পাক-বাহিনীর সহযোগী হিসাবে আবির্ভূত হয়ে ঘৃণ্যতম কাজ করেছিলেন। আমরা আইনী-পন্থায় বিচারের মাধ্যমে তাদের নায্য সাজা প্রাপ্তি দেখতে চাই। আইনী বিচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো মাপকাঠি হবে গণহত্যা-সহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধ সংঘটনে যুক্ত থাকার প্রসঙ্গটি।
কিন্তু যারা বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে গণহত্যা-গণধর্ষণ, লুন্ঠনবৃত্তি-ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, টানা নয়টি মাসের প্রত্যেকটি সেকেন্ডে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছিলেন তাদের বিচারের ব্যাপারটি ভুলে থাকছি কীভাবে আমরা? পাকিস্তানী সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্ব বাঙালীর স্বাধীনতার সাধ চিরদিনের মতো ঘুচিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আক্ষরিক অর্থেই রক্তাগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলেন একাত্তরে। তারা একাত্তরের মার্চের শেষ থেকে মধ্য-ডিসেম্বর সময়-কালে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম একটি গণহত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। এ-প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকার দায়-দায়িত্ব গ্রহণে পাকিস্তানকে বাধ্য করা, দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা, ক্ষতিপূরণ আদায় করা থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধ সংশ্লিষ্ট অনেক কয়টি অপরাধের ব্যাপারে পাকিস্তানের সাথে ফয়সালার কাজ বাকী পড়ে আছে।
যুদ্ধাপরাধের স্থানিকীকরণের পরিণততে গোলাম আযম-মওলানা নিজামীরা একমাত্র প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলে, জুলফিকার ভূট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়াদের অপরাধ বিস্মৃত হয়ে পড়বো আমরা। এটা শুধু বাংলাদেশ নয় সারা-বিশ্বের শান্তিকামী মানবতার জন্যও হবে দুঃখজনক একটি ঘটনা।
আপলৌড ১৬ ডিসেম্বর ২০০৮